সদাশিবের ছোটবেলার বন্ধু কুঙ্কু, গ্রামের মোড়ল বিথ্থল পাঠিলের মেয়ে। তার পরামর্শ মতই সদাশিব শিবাজীর সেনাদলে যোগ দেওয়ার জন্য গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। (তথ্যসূত্রঃ 'ছবিতে গল্প' ব্লগ)
কার্টুনিস্ট ও কমিক্সের একনিষ্ঠ পড়ুয়া, ঋতুপর্ণ বসু লিখছেন সদাশিব সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য ও সদাশিব কমিক্স সৃষ্টির কথা:
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই শিশুপাঠ্য কাহিনীকে রং তুলিতে জীবন্ত করে তুলেছিলেন শিল্পী বিমল দাস ( ১৯৩৫ - ২০০২ )।
১৯৫৯ সালের এপ্রিলে নিউ এজ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয় ' সদাশিবের তিনকান্ড ' ।
আদিকান্ড, অগ্নিকাণ্ড ও দৌড়োদৌড়ি কান্ড - একত্রে।
বইটি শরদিন্দুবাবু উৎসর্গ করেন রাজশেখর বসুকে।
ছত্রপতি শিবাজীকে কেন্দ্র করে সাহিত্যরচনার কথা রাজশেখর বসুই প্রথম বলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধায়কে। শরদিন্দুবাবু তখন পুণাপ্রবাসী।
১৯৫১ সালের ৯ই জুলাই একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, " শিবাজী আওরংজেবের বিরোধ উপলক্ষ্য করে এবং একজন বীর সৈনিককে নায়ক করে আপনি যদি ওই ধরনের গল্পাবলী লেখেন তবে তা আবালবৃদ্ধবণিতার প্রিয় হবে বলে মনে করি। "
এরপরেও নিয়মিত রাজশেখর বসু তাঁকে এই বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। শরদিন্দুবাবুর " বাঘের বাচ্চা " গল্পটি এই বিষয়ের ওপরেই ভিত্তি করে লেখা।
সদাশিবের প্রথম আত্মপ্রকাশ মৌচাক পত্রিকায়। (আদিকান্ড , ১৩৬৪, ১২ই জৈষ্ঠ )
পরের বছর মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় অগ্নিকান্ড।
এরপরের পর্বগুলিও তুমুল জনপ্রিয় হয়।
ইন্ডিয়ান এসোসিয়েটেড পাবলিশিং হাউস থেকে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় সদাশিবের হৈ হৈ কান্ড।
পন্চম এবং শেষ কাহিনী ঘোড়া ঘোড়া কান্ড প্রকাশিত হয়েছিল শারদীয়া সন্দেশ পত্রিকায়, ১৯৬২ সালে।
আরো চারটি কাহিনীর খসড়া শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোটবুকে পাওয়া যায়। এগুলি হল, যথাক্রমে -- সদাশিবের রক্তারক্তি কান্ড, সদাশিবের কেলেঙ্কারি কান্ড, সদাশিবের বিদঘুটে কান্ড ও সদাশিবের মহামারী কান্ড।
তবে ঐগুলি তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। মনে হয় শিবাজীর উত্থানপর্বের সমগ্র ইতিহাসটিকে সদাশিবের অভিযানের মাধ্যমে গল্পচ্ছলে ধরার পরিকল্পনা করেছিলেন। সে আর হল কই ?
আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত শরদিন্দু রচনাবলীর চতুর্থ খন্ড সদাশিবের সবটি গল্প সংকলিত হয়েছে।
আমার বন্ধু শিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত শিল্পের নানা বিষয় নিয়ে মূল্যবান গবেষণা করে চলেছে। শিল্পী বিমল দাসকে নিয়ে তার অন্বেষণে অবধারিতভাবেই এসেছে সদাশিবের প্রসঙ্গ।
আনন্দমেলার তৎকালীন সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সাথে তাঁর কথোপকথনটি তুলে দিলাম।
' আনন্দমেলায় একটা সময়ে আমাদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সদাশিবের কমিকস। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে তৈরী এই কমিকস এঁকে ছোটদের মনে একেবারে পাকাপাকি সম্রাটের আসন দখল করেছিলেন বিমল। এত উন্নতমানের কমিকস, তার আগে ও পরে কখনও হয়নি। অন্ততঃ আমাদের বাংলায়। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে জিজ্ঞেস করি সেই কথা। কিভাবে তৈরী হল সদাশিবের কমিকস ?
নীরেন্দ্রনাথ বললেন, --- আমার মাথায় প্রথম যেটা এসেছিল তা হল আমরা তো অনেক বিদেশী কমিকস বাংলায় অনুবাদ করে ছাপছি। টারজান করছি, টিনটিন করছি, কিন্তু আমাদের দেশের জিনিস নিয়ে কেন কিছু হচ্ছে না ? আমাদের এখানে যা কিছু সেগুলো ছবির দিয়ে তেমন তাক লাগানো কিছু নয়। আনন্দবাজারের অন্যতম কর্ণধার অরূপ সরকারের মাথাতেই প্রথম এসেছিল শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের সদাশিবের গল্পগুলো নিয়ে যদি কমিকস করা যায়। আমারও খুব মনে ধরে আইডিয়াটা। দ্রুত পরিকল্পনা ছকা হয়। বিমলকে দিয়ে ছবি আঁকানোর কথা আমিই বলি। সেও রাজি হয়। তার কাছে এটা ছিল একটা চ্যালেন্জ। ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে সদাশিব। ঠিক হয় সবকিছু ভাল করে দেখেশুনে তারপর ছবি আঁকার কাজে হাত দেবে বিমল। এই যে এতকিছু করে ছবি আঁকা, এটাও বিমলের জীবনে প্রথম। এত টাকাপয়সা খরচ করে কমিকস আঁকার কথা তাঁর মত শিল্পী কি করে ভাববে ! কর্তৃপক্ষ আমাদের অনুমতি দিলে পনের দিনের ছুটিতে আমি আর বিমল যাই দিল্লীতে। কারণ লালকেল্লায় তখনকার আমলের পুরনো জিনিসপত্র রয়েছে, একটা মিউজিয়মও রয়েছে সেখানে। বিমলের পক্ষে সেগুলো দেখা জরুরি। দিল্লি থেকে আমরা যাই পুণায়। ওই পুণা থেকেই আমরা মহারাষ্ট্রের সমস্ত জায়গাগুলোয় ঘুরেছি। ফার্গুসন রোডের একটা হোটেলে আমরা ছিলাম।
আমি সুযোগ বুঝে বললাম, --- এই ভ্রমণের আংশিক বিবরণ আপনি লিখেছেন আপনার 'গঙ্গা যমুনা ' বইতে।
সেই বই আমি পড়েছি জেনে নীরেন্দ্রনাথ একটু খুশি হয়েছেন বলে মনে হল। তারপর বলতে লাগলেন আবার -- প্রথমে আমরা যাই সিংহগড়ে। সেখানে আমরা ছিলাম পুরো একটা দিন।
আমি বললাম, বিমলবাবু কি ওখানে গিয়ে স্কেচ করতেন ?
নীরেন্দ্রনাথ বললেন, -- না, বিমল বলত ওসব তার লাগবে না। সে খালি দেখতো। ফটো তুলত। ওর মেমারি ছিল অসাধারণ। মহারাষ্ট্রের পাহাড়, পাহাড়ি পথ, জঙ্গল, ছোট ছোট গ্ৰাম দুর্গ -- সবকিছু খুঁটিয়ে দেখত বিমল। আমরা দুজনেই তো ছিলাম শুধু। সে এক মজার পর্যটন। প্রথমে আমি বিমলকে বলেছিলাম, --- তুই একাই যা না। গিয়ে ভালো করে দেখে শুনে আয় সব। তা সে কিছুতেই যাবে না। অগত্যা দুজনে মিলেই ঘোরাটা হল।
--- তারপর ?
--- তারপর আর কি ? কলকাতায় ফিরেই শুরু হয়ে গেল কাজ। সব দেখেশুনে বিমল তো চার্জড হয়েই ছিল।
---- আর চিত্রনাট্য ? তরুণ মজুমদার কে দিয়ে করানো হয়েছিল তো সদাশিবের স্ক্রিপ্ট ?
----- তরুণ মজুমদারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল খুব ভালো। আমি যখন সদাশিবের পুরো বিষয়টা তরুণ মজুমদারকে বলি, উনি শুনেই প্রায় তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে যান। ছবির মধ্যে ওই যে সংলাপগুলো, সেগুলো তো কমিকস - এর ওই সাদা বেলুনের ( ফাঁকা ফাঁকা জায়গাগুলো ) মধ্যে দিতে হয় । যিনি স্ক্রিপ্ট রাইটার , তিনি এগুলো ভালো বুঝবেন। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ইতিমধ্যে আমার যোগাযোগ হয়েছিল। তিনি কিভাবে এই কাজগুলো করেন সেগুলো বোঝার চেষ্টা করি। যাঁরা কমিকস করেন তাঁদের পক্ষে এটাই হল আইডিয়াল। কিন্তু সত্যজিৎ রায়কে দিয়ে তো আর এই কাজ করাতে পারব না। নেক্সট লোক হিসেবে তরুণ মজুমদারের কাছেই যাই। তরুণবাবুও যে টাকার জন্যেই এই কাজটা করেছিলেন তা নয়। একটা ভালোবাসার ব্যাপারও নিশ্চয়ই ছিল তাঁর মধ্যে।
আমি শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাই। সদাশিব যখন আনন্দমেলায় বেরোতে শুরু করে তখন আমি কতটুকুই বা। সে বয়সে তো এত কিছু বোঝার কথা নয়। কিভাবে একটা কমিকস তৈরী হয় ! এখন ভাবলে কেমন আশ্চর্য লাগে। একটি কমিকস - এর জন্য খ্যাতনামা চলচ্চিত্র পরিচালককে বলা। বিদেশে হয়তো এমনটা হয়।
নীরেন্দ্রনাথ বললেন, --- তরুণ মজুমদারের মত এত বড় মাপের চিত্র -পরিচালক কমিকস - এর জন্য স্ক্রিপ্ট লিখছেন, এতটা হয়ত বিদেশেও হয় না। বিদেশে অনেকরকমের লোকজন রয়েছেন, যাঁরা এইসব কাজের জন্যেই রয়েছেন। তাঁরা পেশাদারিভাবেই এইগুলো করেন। আমাদের দেশে তো তেমন ব্যবস্থা নেই। কাজেই যা করার সবটাই।নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে হয়।
নীরেন্দ্রনাথ বলছিলেন সদাশিবের প্রস্তুতি পর্বের কথা, আর আমি ভাবছিলাম আমাদের সেই বর্ণময় শৈশবের দিনগুলির কথা। সদাশিবকে কতভাবেই না নকল করেছি তখন। তারপর বেশ কয়েকবছর সদাশিবের সঙ্গে ঘর করার পর হঠাৎই একদিন দুম করে বন্ধ হয়ে যায় সেই কমিকস। অমন প্রত্যাশা জাগানো একটা কাজ , পূর্ণতা প্রাপ্তির আগেই চিরতরে থেমে গেল। এ ঘটনা আমি বা আমার সমকালের বন্ধুরা কেউই মেনে নিতে পারিনি। কতরকমের গুজব শুনেছি, ঠিক বিশ্বাস হয়নি।
এতদিনে আনন্দমেলার সম্পাদককে জিজ্ঞেস করার সুযোগ হল সে কথা। আমার প্রশ্ন শুনে নীরেন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর বললেন, -- সেই সময়টায় আমাদের অফিসে খুব লেবার ট্রাবল চলছিল। তার ফলে তখন কিছুদিন আনন্দমেলা খুব খারাপ ছাপা হয়েছে। এমনও হয়েছে যে দেখা গেছে সদাশিব - এ শিবাজীর ছবি ছাপা হয়েছে, তাঁর দাড়ির রং সবুজ। কলকাতা থেকে চলে গিয়ে আমাদের কাগজ ছাপা হতে থাকে মাদ্রাজে। আমাকেও মাদ্রাজে যেতে হয়েছে মাঝে মাঝে। অবশ্য পুরো সদাশিব পর্বই যে লেবার ট্রাবলের মধ্যে চলেছে তা নয়। থেকেথেকেই গন্ডগোল হত। তার ফলে আমারও মন ভেঙে যাচ্ছিল। বিমল অত পরিশ্রম করে আঁকত, আর ছেপে আসার পর তার চেহারা দেখে মন খারাপ হয়ে যেত। অত সুন্দর রং, ডিটেলিং কিছুই প্রায় বোঝা যেত না। তারপর আমি মাঝপথে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আনন্দমেলা থেকে সরে গেলাম। আমাকে আনন্দবাজার পত্রিকার এডিটোরিয়াল আ্যডভাইজার করে দেওয়া হল। আনন্দমেলার সম্পাদক হলেন অন্যজন।
নীরেন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন ঠিকই কিন্তু তা আমার মনের মত হল না। হয়ত উনি ঠিকই বলেছেন। তবু শুধুমাত্র এই কারণে সদাশিব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ভাবতে পারি না এখনও। অনেকে বলেন আনন্দমেলার সাইজ বদলে যায়, ছোট থেকে বড় আকৃতিতে বেরতে থাকে। তার ফলে নাকি সদাশিব কমিকস প্রকাশে সমস্যা দেখা যায়। কিন্তু সেই সময় টিনটিন সহ আরো কমিকসও তো বেরিয়েছে। তাদের বেলায় তো সাইজের পরিবর্তন কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি। তাহলে ?
কোন উত্তর নেই। তাছাড়া, অনেক পরে এই তো কয়েক বছর আগে হঠাৎ সংবাদ পেলাম সদাশিব কমিকস বই আকারে প্রকাশিত হবে। আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলাম। দেশ পত্রিকার পাতায় বিজ্ঞাপনও বেরিয়ে গেল। দিন গুনছি কবে ফিরে পাব স্বর্ণালী শৈশবের সেই দিনগুলি। সহসা জানতে পারলাম আইনি জটিলতায় সদাশিবের প্রকাশ।বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারা যেন বললেন ১৯৯৯তে
আনন্দবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণে অনেক মূল্যবান জিনিসের সঙ্গে সদাশিবের মূল আর্টওয়র্কও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আর যেহেতু ছাপা- কপি থেকে আনন্দ পাবলিশার্স কমিকস ছাপে না, তার জন্য নাকি সদাশিব বই হয়ে ওঠেনি। নীরেন্দ্রনাথ অবশ্য এতকিছু বিষয় জানেন না বললেন।
সদাশিব বই আকারে পাবো না জেনে আমি অবশ্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুরোনো আনন্দমেলা থেকে প্রাপ্ত সদাশিব কমিকস এর পুরোটাই রঙ্গিন প্রিন্ট করে বই আকারে বাঁধিয়ে রেখেছি। মাঝেমাঝে তার পাতা ওল্টাই আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
কত যত্ন আর মমতা নিয়ে এমন সুন্দর একটি কমিকস রচনা করেছিলেন বিমল দাস। এমনকি শুনেছি সদাশিব রচনার জন্য বিমল দাসকে অন্যান্য কাজের ভার দেওয়া হত না তেমন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও স্বীকার করলেন সেকথা। বললেন, --- বিমল ছবি আঁকতে প্রচণ্ড সময় নিত এবং আমি ওকে বিরক্তও করতাম না। ও জানতো এই তারিখের মধ্যেই ওকে কাজ জমা দিতে হবে, না হলে এই সংখ্যায় বেরোবে না। কিন্তু বিমল আমাকে কখনও ডোবায়নি। তবে আমিও ওকে আনন্দমেলার পাতায় অন্য কাজ দিতাম না, যাতে সে নির্বিঘ্নে সদাশিব এঁকে যেতে পারে। '
( বিমল দাস ; জলরঙের জাদুকর : কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত , পৃষ্ঠা : ৪৯ - ৫৪ )
এখন গ্ৰাফিক নভেল নিয়ে কত মাতামাতি চলছে। কিন্তু আমাদের দেশে, এই বাংলায় যে সদাশিবের মত এত উৎকৃষ্ট মানের কাজ হয়েছিল, তা বিশ্বের যে কোন বহুচর্চিত গ্ৰাফিক নভেলের পাশে দাঁড়াবার যোগ্যতা রাখে।
কমিকসটি অসমাপ্ত অবস্থায় ১৯৮৫ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
দারুন লেখা। অনেক তথ্য জানতে পারলাম, অনেক তথ্য না পেয়ে মন খারাপ ও হলো। যাই হোক এমন অনেক লেখা আসুক।
ReplyDelete