লম্বু-মোটুর চরিত্র-পরিচিতি; হিন্দি ডায়মন্ড কমিক্সের সূচনা

90 এর দশকের, বিশেষত বাঙালি ছেলেমেয়েদের ছোটবেলার সাথী, ডায়মন্ড কমিক্স এর সূচনা হয় 1979 সালে, হিন্দি ভাষায়।
1979 সালটিকে UNESCO এর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ (International year of the child) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই উপলক্ষে ডায়মন্ড পকেট বুকস এর তরফ থেকে ঐ বছরের মার্চ মাসে ডায়মন্ড কমিক্স প্রথম প্রকাশিত হয়।


তখন ডায়মন্ড কমিক্স বেরোতো সেট হিসেবে। একদম প্রথম সেটের বই হিসেবে ছিল 4টি বই- লম্বু-মোটু, ফৌলাদি সিং, মামা-ভাঞ্জা ও চাচা-ভাতিজা। 4টি বইই একেবারে সাদা-কালো। প্রতিটি বইয়ের দাম ছিল ২.৫০ টাকা। "লম্বু-মোটু মুরদো কি বসতি মে"- ডায়মন্ড কমিক্সের প্রথম এবং লম্বু-মোটু সিরিজের প্রথম বই। অন্য তিনটি সংখ্যা:

ফৌলাদি সিং ও লৌহমানব
মামা-ভাঞ্জা আর চালাক খরগোশ
চাচা-ভাতিজা আর জাদুপ্রদীপ




1978 থেকে ছোটো সাইজের গল্পের বই (ডায়মন্ড পকেট বুকস) বেরোতো, তবে সেটি কোনো বিশেষ চরিত্রকে কেন্দ্র করে নয়। প্রথমদিকে সম্ভবত দুটি ফ্যান্টমের গল্প হিন্দিতে অনুবাদ করা হয়।

প্রথম চারটি কমিক্স সংখ্যা বাজারে মোটামুটি জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরে ডায়মন্ড কমিক্স সেগুলির পুনর্মূদ্রণ করে, দাম ৩ টাকা। তবে এবারে তারা সবুজ ও কমলা রঙে ছাপায় (Monotonus); খরচা কমানোর জন্য পৃষ্ঠা সংখ্যা কমিয়ে দেয়। প্রথম ৮-১০টি সংখ্যা এভাবে ছাপানোর পর, ডায়মন্ড কমিক্স সম্পূর্ণ রঙীন(চার রঙের) বেরোনো আরম্ভ হয়। কমিক্স এর চরিত্র হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার পর সেগুলিকে নিয়ে আবার ডায়মন্ড পকেট বুকস থেকে আলাদা গল্প বেরোয়। পকেট বুকস গুলির গল্প লিখতেন জনৈক রাজীব।

১ম সংখ্যা(১ম প্রকাশ)


২য় সংখ্যা 



তখনকার ডায়মন্ড কমিক্সের সেট এ কখনো আসতো 4টি বই, কখনো 5টি, আবার কখনো 6টি। প্রথম 3টি সেটেই লম্বু-মোটুর কমিক্স ছিল। প্রথমদিকের ডায়মন্ড কমিক্সের বেশিরভাগ গল্প লিখতেন অশ্বিনী "আশু"(পদবী নাকি ছদ্মনাম?), লম্বু-মোটুর শুরুর দিকের গল্পগুলি ওনারই লেখা।

লম্বু-মোটুর কমিক্স এঁকেছেন একাধিক শিল্পী। প্রথম তিন কমিক্সের শিল্পী S. Chitrak. চতুর্থ কমিক্স "খতরনাক চিটঠি "র শিল্পী- Pramod Tarpati.



৪র্থ সংখ্যা


৫ম ও ৬ষ্ঠ গল্পের শিল্পী- Rita Naiyyer.



নীলগড়ি কা খাজানা ও ওতন কে রাখওয়ালে'/মতওয়ালে'র শিল্পী বিখ্যাত কার্টুনিস্ট সুধীর তৈলং







গদ্দারো কি টোলি এবং গদ্দারো কা বিনাশ এর শিল্পী- Anupam Sinha.


মউত কা যুদ্ধ- শিল্পী যুগল কিশোর


সম্ভবত মউত কা বাদশাহ- কমিক্সটি থেকে লম্বু-মোটুর কমিক্সের স্থায়ী শিল্পী হয়ে দাঁড়ান বিজয় পন্ডিত। লম্বু-মোটুর বেশ কিছু কমিক্স উনি এঁকেছেন। এছাড়া ওনার পরে আরও অনেকে এঁকেছেন...এদের মধ্যে নীরদ, বিনোদ ভাটিয়া, আদিল খান প্রধান।


বাংলায় লম্বু-মোটুর প্রথম কমিক্স- লম্বু-মোটু ও বিষাক্ত রক্ত(ডিসেম্বর, ১৯৯৪); দাম ৮ টাকা।ইংরেজি/হিন্দিতে লম্বু-মোটুর প্রায় ১০০'র কাছাকাছি কমিক্স থাকলেও বাংলায় ৩৫ টি কমিক্স প্রকাশিত হয়েছে(অন্ততপক্ষে)।





কারা এই লম্বু-মোটু? এটাই কি তাদের আসল নাম?

এই প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয়, সব বা বেশিরভাগ বিখ্যাত কমিক্স চরিত্রের একটি origin story দেখানো হয়, অর্থাৎ যেখানে আছে সেই চরিত্রের ছোটবেলা, তার বিখ্যাত হওয়ার বা হিরো হওয়ার আগের ঘটনা। একটি চরিত্র যখন সৃষ্টি হয়, তখন লেখক বা শিল্পী হয়তো সেকথা ভাবেন না, কিন্তু পরের গল্পে কখনো তাদের এই ছোটবেলার ঘটনা গুলো দেখানো হয়। যেরকম ব্যাটম্যানের "ব্যাটম্যান" হওয়ার আগের অর্থাৎ ব্রুস ওয়েনের ছোটবেলার গল্প আছে, ঠিক সেরকম। এক্ষেত্রে origin story ও প্রথম গল্পের তফাত থাকতে পারে। 

লম্বু-মোটুর ক্ষেত্রেও ঠিক সেই জিনিস হয়েছিল। লম্বু-মোটুর প্রথম গল্পে দেখানো হয়েছিল লম্বু-মোটু দুই বন্ধু। লম্বু এসেছে তার মামার গ্রামের বাড়িতে, সঙ্গে এসেছে মোটু। সব গল্পেই দেখানো হয়েছে লম্বু-মোটু দুই বন্ধু, দুঃসাহসী যুবক, অপরাধীদের ধরতে পুলিশকে তারা সাহায্য করে। 

কিন্তু আপনাদের যদি বলি লম্বু-মোটু একেবারেই বন্ধু ছিল না? এমনকি ছোটবেলায় একে অপরকে একদম সহ্য করতে পারতো না? আপনি বিশ্বাস করবেন?

না তো.. আমারও বিশ্বাস হয়নি ... 

লম্বু-মোটুর ছোটবেলার এই গল্প জানতে হলে আপনাদের পড়তে হবে


"প্রতিশোধ কে অঙ্গারে" (প্রতিশোধের আগুন) কমিক্সটি। কমিক্সটি বাংলায় অপ্রকাশিত।

এই গল্পটিও লিখেছেন অশ্বিনী "আশু"। 

কমিক্সটির কিছু পাতা তুলে ধরছি, যাতে গল্পটা আপনারা বুঝতে পারেন...


ইন্সপেক্টর চৌহানের বড় ছেলের নাম অজয় ইন্সপেক্টর পাণ্ডের বড় ছেলের নাম বিজয়এদেরকেই আমরা চিনি- "লম্বু-মোটু" নামে। ইন্সপেক্টর পাণ্ডে ও ইন্সপেক্টর চৌহান ভালো বন্ধু ছিলেন, কিন্তু তাদের দুই ছেলে একেবারেই বিপরীত। একদম দেখতে পেত না একজন অন্যজনকে। বাবারা চাইতেন তাদের ছেলেরাও যেন বন্ধু হয়ে পড়ে। 

একদিন এলাকার কুখ্যাত গ্যাং "টাইগার ফোর্স" এর লোকদের সঙ্গে লড়াইয়ে অজয়-বিজয় তাদের বাবাদের সাহায্য করে। এতে টাইগার ফোর্স এর কিছু লোক ঘায়েল হয়, অনেকে ধরা পড়ে। তাদের নেতা "জ্বয়ালা সিং" ঠিক করে গোটা শহরকে তারা আক্রমণ করবে। বাচ্চা-বুড়ো কাউকে তারা বাদ দেয় না, লোকজন দেখলেই এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে। 


অতর্কিত আক্রমণে শহরের যা তা অবস্থা, টাইগার ফোর্স এর সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন ইন্সপেক্টর চৌহান ও ইন্সপেক্টর পাণ্ডে দুজনেই। এমনকি তাদের পরিবারেরও সবাই মারা যায়, শুধু তাদের দুই ছেলে বাদে; আরও অনেক পুলিশকর্মী, সাধারণ মানুষ আহত ও নিহত। 

 লম্বু-মোটুর পরিচয় হয়েছিল আর এক ইন্সপেক্টর কাকু(জেলার) এর সাথে। তিনি ভেবেছিলেন... অজয়-বিজয়ও বুঝি... কিন্তু জানা গেল, না... যখন এই ঘটনা ঘটেছে শহরের বুকে, তখন অজয়-বিজয় সেখানে ছিল না। তারা ছিল কিছুটা দূরে, "মাস্টার সাইতান"এর  ক্লাবে তারা তখন মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। 


ফোন পেয়েই তারা বাড়ি ফিরল... আর যা দেখতে পেল... 



টাইগার ফোর্স এর দলের একজনের মুখোশ খুলে ফেলে তারা সেই লোকটাকে চিনতে পারল... তার দাদা কোথায় থাকে তারা জানতো... চলে গেল সেখানে... 

উপরের ছবির সংলাপ এরূপঃ 

"বল, ওর দাদা কোথায়?  কোথায়?...বলবি না?..." 

আরও কিছু গুণ্ডাঃ- "এই লম্বু! এই মোটু"! 
কারা তোরা? তোদের এত সাহস যে এখানে এসে মারপিট করছিস?" 

-" আরে, তোরাই তো একটু আগে আমাদের ডাকছিলি- "লম্বু-মোটু" নামে।  ভাব, এটাই আমাদের নাম।"

(এইভাবে অজয়-বিজয় এর নাম হল "লম্বু-মোটু", স্থানীয় গুণ্ডাদের দেওয়া!)

"এতক্ষণ তোরা যা দেখেছিস, সেটা তো শুধু ট্রেলার ছিল! আসল মারপিট তো এখনও বাকি আছে... তোর আর তোর এই চামচাগুলোর সাথে"! 

তারপর শুরু হল দ্বন্দ্বযুদ্ধ... যুদ্ধে লম্বু-মোটু ধরাশায়ী করে দিয়েছিল টাইগার ফোর্স এর দলের সবাইকে। 

দলের সবাইকে মেরে কাঠগড়ায় উঠল লম্বু-মোটু... কিন্তু এমন এক প্রতাপশালী দলকে নির্মূল করে দেওয়ার জন্য বিচারক তাদের শাস্তি মোকুব করে দেন। 

আর তারপর থেকেই, দুরন্ত দুর্ধর্ষ লম্বু-মোটু জুটি বেঁধে একের পর এক অপরাধীদের শায়েস্তা করে গেছে। 


ছবি ও তথ্য সহায়তাঃ Hemendra Singh, Adarsh Rana, Gaurav Gandher, Hasan Zaheer, Mohit Pandey, Sagar Rana, Supratim Saha, comicsbyte, Rare comic covers blog.

1 comment:

  1. আরে বাপ রে!! দারুন তথ্য । নরুন তথ্য। সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete